জাহেল বলতে এমন কাউকে বুঝায় যে অজ্ঞ, মূর্খ, বোকা, যার আচরণ মূর্খতাপূর্ণ।
১৪০০ বছর পার হয়ে গেছে সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দায়িত্ব ও মিশন সুচারুভাবে পরিপূর্ণ করে চলে গেছেন। যখন তিনি মানবতার মুক্তির জন্যে দুনিয়াতে এসেছিল... েন তখন সারা দুনিয়া ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, অন্ধকারটি আর কিছুই নয় মূর্খতাপূর্ণ আচরণের অন্ধকার বা এক কথায় জাহেলিয়াতের অন্ধকার।
বর্তমানে আমরা অবস্থান করছি একুশ শতকে। আমাদের চারিদিকে নিত্য নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি আর বিলাস দ্রব্যের ছড়াছড়ি। এগুলো যেন মানুষের মন মগজ আর দৃষ্টিকে ধাঁধিয়ে দেয়।
দুনিয়ার এই বাহ্যিক চাকচিক্য ও জীবনকে আরামদায়ক করার নানা উপায় উপকরণ ও প্রযুক্তির ছড়াছড়ি দেখে অনেক মানুষকেই আজকাল বলতে শোনা যায়, পৃথিবী ও মানব সভ্যতা তার উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। কুসংস্কার আর অন্ধকার থেকে মানব জাতি মুক্তি পেয়েছে।
কিন্ত আসলেই কি তাই ? আমরা কি সত্যি মুক্তি পেয়েছি, আমাদের মূর্খতাপূর্ণ আচরণ থেকে?
নাকি যে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি তা সেই ১৪০০ বছর আগের অন্ধকার জাহেলিয়াহ?
মূর্খতাপূর্ণ আচরণ একটি নয়, অনেক।
একেক ভূমি, জাতি কিংবা যুগে এর আচরণের রূপ পাল্টালেও একটি বিশেষ বিষয় আছে যাতে এই সমস্ত মূর্খ লোকদের মাঝে মিল দেখা যায়। সেই বিশেষ আচরণটি কি?
একটি গাছ কি কখনো আরেকটি গাছকে তার রব বা প্রভূ বলে মেনে নেয়?
একটি পাথর কি কখনো অন্য আরেকটি পাথরকে সিজদাহ করে
কিংবা অন্য যে কোন প্রাণী কি তারই মত আরেকটি প্রাণীকে বলে, তুমিই আমার রব?
না, বলে না। কিন্তু, মানুষের মূর্খতাপূর্ণ আচরণ যেন অন্যান্য প্রাণীদেরকেও লজ্জা দেয়। এই মানুষকেই দেখা যায় অন্য আরেকটি মানুষকে সে রব বা তার মালিক বলে মেনে নেয়। সে তারই মত আরেকটি মানুষের হাতেই অর্পণ করে সমস্ত ক্ষমতা, অর্পণ করে সার্বভৌমত্ব আর অর্পণ করে হুকুম দেয়ার শর্তহীন ক্ষমতা আর সেই হুকুম মেনেও নেয় চোখ বন্ধ করে নিঃশর্তভাবে, অথচ সে একবারও ভেবে দেখে না আদেশকৃত লোকটি তো তারই মত একটি মানুষ।
আধুনিক যুগের জাহেলরা বা মূর্খেরা আল্লাহকে সরাসরি অস্বীকার করে না, বরং ভাল মন্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ, সমষ্টিগত জীবনের জন্য আইন প্রণয়ন, জীবন বিধান রচনা ও নির্বাচনের অধিকার দাবীর মাধ্যমে সে আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কারণ, উল্লেখিত বিষয়গুলোতে আল্লাহ যে নির্দেশাবলী দিয়েছেন, তা অস্বীকার করেই কোন মানুষ এ কাজগুলো করতে পারে। আল্লাহর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহের অনিবার্য পরিণতিই হচ্ছে তাঁর সৃষ্টির উপর যুলুম ও নির্যাতন।
বর্তমান পৃথিবীতে প্রধান সমাজ চারটি
-মানব রচিত মতবাদ ভিত্তিক সমাজ বা সেকুলার সমাজ
-ইহুদী, নাসারাদের সমাজ
-পৌত্তলিকদের সমাজ
-মুসলিমদের সমাজ
আসুন দেখি এই চারটি সমাজে বর্তমান মূর্খতাপূর্ণ আচরণের স্বরূপটি কেমন,
নিচের লেখাটি লিখেছেন সাইয়েদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ।
শুরুতেই দেখা যাক জাহেলিয়াত ভিত্তিক সমাজ বলতে আমরা কি বুঝি এবং
ইসলাম কিভাবে এ সমাজের মুকাবিলা করতে চায়ঃ
ইসলামী সমাজ বহির্ভূত সকল প্রকারের সমাজ ব্যবস্থাই জাহেলিয়াত ভিত্তিক সমাজ। আরও স্পষ্ট ভাষায় এ সমাজের সংজ্ঞা দান করতে হলে বলতে হয়, যে সমাজের আকীদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, ইবাদাত-বন্দেগী ও রীতিনীতি এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে রচিত নয় সে সমাজই জাহেলিয়াতের সমাজ।
এ সংজ্ঞানুসারে বর্তমান বিশ্বে যত সমাজ রয়েছে, সবগুলোই জাহেলিয়াতের সমাজ।
(১) মানব রচিত মতবাদ (জাতীয়তাবাদ, উদারতাবাদ, মার্কসবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি) ভিত্তিক সমাজে জাহেলিয়াহঃ
কম্যুনিষ্ট সমাজ এসব জাহেলী সমাজগুলোর অন্যতম।
আমাদের এ উক্তির প্রথম প্রমাণ এই যে, এ সমাজ আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং বিশ্বাস করে যে, মানুষের সকল ক্রিয়াকলাপ ও তার ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতি অথবা উৎপাদনের উপায় উপাদানের দ্বারা।
দ্বিতীয়ত এ সমাজের সকল রীতিনীতি কম্যুনিষ্ট পার্টির সমীপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে রচিত— আল্লাহর সমীপে নয়।
-দুনিয়ার সকল কম্যুনিষ্ট দেশেই সম্যুনিষ্ট পার্টির হাতে থাকে দেশের পূর্ণনিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব। তাছাড়া এ সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব পরিণতি দাঁড়ায় এই যে, মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে জীবজন্তুর প্রয়োজনীয়তার সমপর্যায়ে বিবেচনা করা হয়। খাদ্য,পানীয়, বস্ত্র, আশ্রয় এবং যৌন প্রবৃত্তির প্রয়োজনীয়তার উর্ধ্বে মানুষের অন্য কোন প্রয়োজনীয়তার বিষয় এ সমাজে চিন্তা করা হয় না। কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থা মানুষের আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছে। অথচ মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের পার্থক্য সূচিত হয় এখান থেকেই। আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের প্রথম ধাপই হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং এ বিশ্বাস সম্পর্কে প্রকাশ্য ঘোষণা করার স্বাধীনতা। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, এ সমাজ ব্যবস্থা মানুষের ব্যক্তি সত্তা বিকশিত করার স্বাধীনতা হরণ করে।
মানুষের ব্যক্তি সত্তা নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করে।
এক: ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা।
দুই: পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা।
তিন: যে কোন পেশায় বিশেষ দক্ষতা অর্জনের অধিকার ও সুযোগ।
চার: বিভিন্ন শিল্প কলার ভিতর দিয়ে নিজের মনোভাব প্রকাশ করার অধিকার।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর ভিতর দিয়েই মানুষ পশু যন্ত্রের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। কিন্তু কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থা মানুষকে এসব বিষয় থেকে বঞ্চিত করার দরুণ তারা জন্তু-জানোয়ার এবং যন্ত্রের পর্যায়ে নেমে যেতে বাধ্য হয়।
(২) পৌত্তলিক সমাজে জাহেলিয়াহঃ
পৌত্তলিক সমাজেও জাহেলিয়াতের একই রূপ। ভারত, জাপান, ফিলিপাইন ও আফ্রিকাতে এ ধরনের সমাজ রয়েছে। পৌত্তলিকতাবাদী জাহেলিয়াতের পরিচয় নিম্নরূপ:
এক: তারা আল্লাহর সাথে অন্য কাল্পনিক আল্লাহর বন্দেগী করে— কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য আল্লাহ গ্রহণ করে নেয়।
দুই: তারা নানাবিধ দেব-দেবীর পূজা-উপাসনা করার জন্যে বিস্তারিত নিয়ম-পদ্ধতি রচনা করে রেখেছে।
অনুরূপভাবে তাদের আইন-কানুন ও রীতিনীতি অর্থাৎ তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী আল্লাহ তাআলার দেয়া শরীয়ত পরিত্যাগ করে অন্যান্য উৎস থেকে রচিত। এসব উৎসের মধ্যে রয়েছে ধর্মযাজক, জ্যোতিষী, যাদুকর, সমাজের নেতা এবং আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াতের প্রতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব আরোপ না করে জাতি, দল অথবা অন্য কোন বিষয়ের নামে আইন রচনা করার পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণকারী সংস্থা।
অথচ আইন রচনার নিরম্কুশ ক্ষমতা আল্লাহ তাআলার এবং একমাত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর অনুসৃত পন্থায়ই এ আইন কার্যকরী করা যেতে পারে।
(৩) ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের সমাজে জাহেলিয়াহঃ
ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের দ্বারা গঠিত সকল সমাজই জাহেলিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। কেননা, তারা তাদের মূল আকীদা-বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এবং আল্লাহর গুণাবলী থেকে কিছু অন্যান্য শক্তির উপর আরোপ করেছে। তারা আল্লাহর সাথে মানুষের বিচিত্র ধরনের সম্পর্ক কল্পনা করে থাকে। কোন কোন ব্যক্তিকে তারা আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে। পুনরায় এক আল্লাহকে তারা তিন ভাগে বিভক্ত করে ত্রিত্ববাদ সৃষ্টি করেছে। কোন কোন সময় তারা অদ্ভুতভাবে আল্লাহর পরিচয় ব্যক্ত করে, যদিও এ পরিচয় আল্লাহর আসল পরিচয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এরশাদ হচ্ছে, "ইয়াহুদীরা বলে ওযায়ের আল্লাহর পুত্র। আর খৃস্টানরা বলে ঈসা আল্লাহর পুত্র। তাদের পূর্ববর্তী অনুকরণ করে এরা এসব ভিত্তিহীন কথা বলাবলি করে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করবেন — কিভাবে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে”।
—আত তওবা: ৩০
আল্লাহ আরও বলছেন,
"যারা আল্লাহকে তিন জনের অন্যতম বলে, তারা অবশ্যই কুফরী করে। কারণ এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। তারা যদি এসব উক্তি থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করছে তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া হবে।” — আল মায়েদা: ৭৩
আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ও অশোভন ধারণা করে তারা বিচ্যুত হয়েছে ও জাহেলিয়াহ’র অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। দেখুন কুর’আন কি বলছে, "ইয়াহুদীরা বলে আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তাদেরই হাত বাঁধা এবং তাদের অশোভন উক্তি ও কার্যকলাপের জন্যে তারা অভিশপ্ত। আল্লাহর হাত মুক্ত এবং তিনি যেভাবে ইচ্ছা খরচ করেন।”
— আল মায়েদা: ৬৪
"ইয়াহুদী ও নাছারাগণ বলে থাকে যে, তারা আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়পাত্র। তাদের জিজ্ঞেস কর, যদি তা-ই হয় তাহলে তোমাদের গুনাহের জন্যে তোমাদের শান্তি দেয়া হয় কেন? প্রকৃতপক্ষে তোমরাও আল্লাহর সৃষ্টি অন্যান্য বান্দাদেরই মানুষ মাত্র।” — আল মায়েদা:১৮
এসব সমাজের
পূজা-উপাসনার পদ্ধতি,
রীতিনীত,
আচার-ব্যবহার সব কিছুই তাদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস থেকে রচিত এবং এ জন্যেই এ সমাজ জাহেলী সমাজ।
এগুলো এ জন্যেও জাহেলী সমাজ যে, তাদের সকল সংস্থা ও আইন-কানুন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে নতি স্বীকারের ভিত্তিতে রচিত হয়নি। তারা আল্লাহর আইন মানে না এবং আল্লাহর নির্দেশাবলীকে আইনের উৎস হিসেবে স্বীকার করতেও প্রস্তুত নয়। পক্ষন্তরে তারা মানুষের সমন্বয়ে গঠিত আইন পরিষদকে বিধান প্রণয়ণের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রদান করেছে।
অথচ এ ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর জন্যে সুনিদিষ্ট। কুরআন নাযিলের যুগে যারা তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিল,ফলে কুরআন তাদেরকে মুশরিক আখ্যা দান করেছে।
কুর’আন বলছে,
"তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের ওলামা ও পুরোহিতদের ‘রব’ বানিয়ে নিয়েছে এবং মরিয়ামের পুত্র মসীহকেও। অথচ এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো বন্দেগী করতে তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি ব্যতীত বন্দেগীর যোগ্য কেউ নেই। তাদের মুশরিক সুলভ রীতিনীতি থেকে আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ পবিত্র।” — আত তওবা: ৩১
এসব লোকেরা তাদের ওলামা ও পুরোহিতদের আল্লাহও মনে করতো না এবং তাদের উপাসনাও করতো না। তবে তারা ঐ সব ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের বিধান মেনে চলতো। অথচ আল্লাহ তাআলা এরূপ করার অনুমতি দেননি। তাই কুরআন সে যুগে ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের মুশরিক আখ্যা দান করেছে।
আজও একই অবস্থা, পার্থক্য শুধু এটুকু যে আইন রচনার অধিকার ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের হাতে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নির্বাচিত আইন-পরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। বলাবহুল্য, আইন পরিষদের সদস্যগণও ধর্মযাজকদেরই মত মানুষ মাত্র।
(৪) মুসলিম সমাজে জাহেলিয়াহঃ
সর্বশেষে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমান যুগের তথাকথিত মুসলিম সমাজগুলোও জাহেলী সমাজ। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন দেবদেবীর প্রতি ঈমান আনয়ন বা তাদের উপাসনায় লিপ্ত হয়নি। তথাপিও তাদের সমাজ জাহেলী সমাজ। কারণ তারা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী নির্ধারণ করেনি। তারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলার আইন –বিধান রচনা ও প্রবতর্নের অধিকারটিকে তাদেরই মত মানুষের হাতে অর্পণ করেছে এবং মানুষের রচিত রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, আইন-কানুন ও জীবনের মূল্যবোধ ইত্যাদি মেনে নিয়ে জীবনের প্রায় সকল দিক ও বিভাগে মানুষেরই কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছে।
শাসন ও আইন রচনা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন —
"যারা আল্লাহর দেয়া বিধান মুতাবিক বিচার ফায়সালা করে না তারা কাফের।” — আল মায়েদা: ৪৪
আল্লাহ আরও বলেছেন,
"(হে নবী !) তুমি কি ঐসব লোকদেরকে দেখেছ যারা যুগে যুগে দাবী করে যে, তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে, তা সবই সত্য বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু তারা তাদের মামলা মোকাদ্দমা ও বিষয়াদি মীমাংসার জন্য তাগুতের নিকট পেশ করে। অথচ তাগুতকে অস্বীকার করার নির্দেশই তাদের প্রতি দেয়া হয়েছিল। — আন নিসা: ৬০
ইতিপূর্বে আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদী ও নাসারাদের এ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং শির্ক ও কুফরের মাধ্যমে আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার এবং ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের আল্লাহ’র অধিকার প্রদানের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
আজ ইসলামের দাবীদারগণ এসব অধিকার (আইন প্রণয়ন, হালাল-হারাম পরিবর্তন) তাদেরই মত কিছু সংখ্যক মানষের হাতে অর্পণ করে রেখেছে।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়,
ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের মরিয়াম পুত্র ঈসা (আ) –কে ‘রব’ ও ‘ইলাহ’ বানিয়ে তাঁর বন্দেগী করাকে আল্লাহ তাআলা যেভাবে শিরক আখ্যা দিয়েছেন ঠিক সেভাবেই ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের আইন ও বিধান রচনার অধিকার দানকেই শিরক বলেছেন। এ উভয় ধরনের শিরকের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। উভয় ধরনের কাজই এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তাআলার বন্দেগী পরিত্যাগ, আল্লাহর দ্বীন থেকে বিচ্যুতি এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ র সাক্ষ্য দানের পরিপন্থী।
মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে প্রকাশ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতায় (কিংবা সেকুলারিজম, রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিগুলো ধর্মের প্রভাবমুক্ত করা ইত্যাদি) বিশ্বাস করে। দ্বীনের সাথে তাদের সম্পর্কে মোটেই নেই। আবার অনেকে দ্বীনের প্রতি বিশ্বাসী বলে মৌখিক স্বীকারোক্তি করার পর বাস্তব কর্মক্ষেত্রে দ্বীনকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে। তারা বলে যে, তারা অদৃশ্য বিষয় বিশ্বাস করে না। তারা নাকি বিজ্ঞানের ভিত্তিতে তাদের সমাজ জীবনরচনা করতে চায়। তাদের বিবেচনায় বিজ্ঞান ও অদৃশ্য বিষয়াবলী পরস্পর বিরোধী। বলাবাহুল্য, এসব উক্তির কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা। একমাত্র অজ্ঞ ব্যক্তিরাই এ ধরনের উক্তি করতে পারে।
কোন কোন সমাজ আইন –বিধান রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে। ঐসব আইন প্রণেতাগণ নিজেদের খেয়াল খুশী মতাবিক আইন রচনা করে এবং বলে, "এটাই আল্লাহর শরীয়াত।”
এসব সমাজ বিভিন্ন ধরনের হলেও একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। আর সে বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ না করা।
উপরের আলোচনায় সকল ধরনের জাহেলী সমাজ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগী পরিস্কার হয়ে উঠেছে। এক কথায় ইসলাম এসব সমাজকে অনৈসলামিক সমাজ বিবেচনা করে। উল্লিখিত সমাজগুলোর বাহ্যিক নামফলক যাই হোক না কেন, এ বিষয়ে তাদের সকলেরই আভ্যন্তরীণরূপ অভিন্ন। অর্থাৎ তারা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তাআলার সমীপে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে জীবন বিধান রচনা করেনি। এদিক থেকে তারা জাহেলী সমাজের রীতি অনুযায়ী কুফরীর পথাবলন্বী।
"ইব্রাহীমের দীন থেকে কে মুখ ফেরায়? কিন্তু সে ব্যক্তি, যে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করে”।
-বাকারাহ ১৩০
____________________________________
লেখকঃ শহীদ সাইয়েদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ
বইঃ মাইলস্টোন